রাজশাহী, রংপুরসহ সারাদেশে নারী ধর্ষণ-নির্যাতনের সকল ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার ও বিচার, গণপরিবহণসহ সর্বত্র নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের অপচেষ্টাসহ নারীবিদ্বেষী সকল কর্মকান্ড বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ এবং ঐসব ঘটনার সাথে যুক্তদের গ্রেফতার ও বিচার নিশ্চিত করার দাবিতে আজ ২৮ ফেব্রæয়ারি ২০২৫ বিকেল ৪ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের উদ্যোগে প্রতিবাদী সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি প্রকৌশলী শম্পা বসু। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম ঢাকা নগর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক শরীফা বেগম, দপ্তর সম্পাদক লাবনী আক্তার, সাংস্কৃতিক সম্পাদক সুস্মিতা মরিয়ম। সভা পরিচালনা করেন সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম ঢাকা নগর শাখার সাধারণ সম্পাদক রুখশানা আফরোজ আশা।
সমাবশে নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা দেশ থেকে পলায়ন করতে বাধ্য হয়েছে। এই জুলাই-আগষ্ট গণঅভ্যুত্থানে নারীদের বীরোচিত ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আন্দোলন যখন অনেকটাই স্তিমিত সেই সময় নারীরা সমস্ত অচলায়তন ভেঙে রাজপথে বের হয়ে আসে। সে সময় তারা রাতের অন্ধকারে আলোর মতো জ্বলে উঠেছিল। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গসহ সকল ধরনের বৈষম্য থেকে মুক্তির স্বপ্নে শ্রমিক, ছাত্র, নারী, জনতা সকলে গণঅভ্যুত্থানে শামিল হয়েছিল। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই নারীকে আর সেভাবে মূল্যায়ন করা হলো না। নারীর বিকাশের ক্ষেত্রে যে সকল বাধা সমাজে আছে সেগুলো দূর করার উদ্যোগ নেয়া হলো না। বরং তাকে নানা রকম নিপীড়ন নির্যাতনের মাধ্যমে ক্রমেই অমর্যাদাকর পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অভ্যুত্থানের পরপরই কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে একজন নারীকে পুলিশের উপস্থিতিতে ‘এক দল যুবক’ হেনস্থা করল তার পোশাক ও স্বাধীন চলাফেরাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। নানামুখী অপতৎপরতায় একের পর এক নারীদের মর্যাদাবোধে আঘাত হানা হচ্ছে। কখনো ধর্মীয় মৌলবাদীদের দ্বারা কখনওবা ‘তৌহিদী জনতার’ উচ্ছৃঙ্খল ¯্রােত দ্বারা। এসব ঘটনার সাথে জড়িত কাউকেই কোন শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। কারা এরা, কি তাদের উদ্দেশ্য, প্রশাসন কেন কোন পদক্ষেপ নিতে পারছে না সেটা জনগণের কাছে স্পষ্ট না। তাহলে কি নিরবতার মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সরকার এ সকল অপতৎপরতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে? নারীকে নির্যাতন, নিপীড়ন, হেনস্থা, ধর্ষণ এমনকি হত্যা করেও পার পেয়ে যাওয়া যায়। এটাতো আমরা ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের আমলে দেখেছি। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত এই অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের সময়েও ঐসবের পুনরাবৃত্তি খুবই দুঃখজনক। জয়পুরহাট, দিনাজপুর, রংপুরসহ বিভিন্ন স্থানে নারীদের ফুটবল খেলায় বাধা, নারী রিপোর্টারকে ধর্ম উপদেষ্টার মিটিং এ প্রবেশে বাধা দেওয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বেগম রোকেয়া ও কুমিল্লায় নবাব ফয়জুন্নেসার ছবিতে কালি লেপন, নারীদের যত্র-তত্র হেনস্থা করা, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনে আলটিমেটাম দেওয়া, বইমেলায় স্যানিটারি ন্যাপকিনকে গোপন পণ্য আখ্যায়িত করে সেই স্টল বন্ধ করাসহ নানা রকম নারী বিদ্বেষী কর্মকান্ড চলছে। আমরা লক্ষ্য করছি, অন্তর্র্বর্তী সরকার এসব নারী বিদ্বেষী কর্মকান্ড বন্ধে এবং দায়ীদের গ্রেফতার ও বিচারের বিষয়ে ভীষণভাবে উদাসীন। নারী মুক্তি আন্দোলনের পথিকৃত মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ আজ সারা বিশ্বে সমাদৃত। স্প্যানিশ সিনেমা নির্মিত হয়েছে। বেগম রোকেয়ার জীবন সংগ্রাম, কর্ম ও লেখনী নিয়ে বিশ্বে গবেষণা হচ্ছে। যেখানে সারা বিশ্বব্যাপী বেগম রোকেয়াকে সম্মান জানানো হচ্ছে; সেখানে তাঁরই জন্মভূমিতে তাঁর ছবিতে কালি লেপন ও তাঁর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের দাবি ভীষণভাবে উদ্দেশ্য প্রণোদিত। দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের উপর সকল আক্রমণকে বন্ধ না করে, অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি বাস্তবায়ন ও সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় বরং তা মব ভায়োলেন্সের বিস্তৃতি ঘটাচ্ছে। যে নারী সমাজ গণঅভ্যুত্থান সফল করতে জীবন বাজি রাখতে দ্বিধা করে নাই আজ তাদের বর্তমানের সঙ্গে সঙ্গে অতীতের উজ্জ্বল ভূমিকাকেও অস্বীকার করার স্পর্ধা আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজনটুকুও রাষ্ট্রের আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে না।’
নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, ‘একদিকে নারী বিদ্বেষী কর্মকান্ড চলছে অন্যদিকে নারীর উপর নেমে এসেছে ভয়াবহ নির্যাতন নিপীড়ন। সম্প্রতি রাজশাহীগামী বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটলো, গাড়ির স্টাফদের গ্রেফতার করার পর ছেড়ে দেয়া হলো। মামলা হলো তিনদিন পর। পরবর্তীতে জনগনের দাবির প্রেক্ষিতে আবার তাদের গ্রেফতার করা হয়। ২১ ফেব্রæয়ারি ভোরে রংপুরের মিঠাপুকুরে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ফুল সংগ্রহ করতে যাওয়া চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করা হয়। এর আগে ১৬ ফেব্রæয়ারি মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় এক গৃহবধূকে ট্রলারে করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে পদ্মার চরে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। গত ৬ ফেব্রæয়ারি মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখাঁনে স্বামীর কাছে ফেরার পথে অটোরিকশা থেকে নামিয়ে গার্মেন্টসকর্মীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। এই ঘটনাগুলো কেবলমাত্র ২১ ও ২২ ফেব্রæয়ারি ২০২৫ এই দুইদিনের পত্রিকার খবর। এ থেকে বোঝা যায়, সারাদেশে প্রতিদিন কিভাবে নারীরা ধর্ষণ-নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। আমরা অবিলম্বে প্রত্যেকটি নারী ধর্ষণ, নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত দোষীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’
নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে সকল ঘটনার সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেফতার ও বিচার, গণপরিবহণসহ সর্বত্র নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের অপচেষ্টাসহ নারীবিদ্বেষী সকল কর্মকান্ড বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানান।